গ্রীষ্মে কাপ্তাই হ্রদের পানি কমে যাচ্ছে। শুকিয়ে যাচ্ছে কাপ্তাই হ্রদ। এতে প্রভাব পড়েছে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদনে ও মৎস্য উৎপাদনে।

কাপ্তাই হ্রদের পানি কমে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে মৎস্য ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে
দেশের একমাত্র কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের হিসাবে, গতকাল মঙ্গলবার কাপ্তাই হ্রদে পানির উচ্চতা ছিল ৭৩ দশমিক ৮২ ফুট এমএসএল (মিন সি লেভেল)। অথচ রুলকার্ভ অনুযায়ী (সময়সূচিভিত্তিক পানি ওঠানামার মাপ) থাকার কথা ছিল ৭৯ দশমিক ১৫ ফুট। ১৯৭০ সালে জাইকার সমীক্ষায় কাপ্তাই হ্রদের পানির সর্বোচ্চ স্তর পাওয়া যায় ১১৮ ফুট এমএসএল।অথচ এই হ্রদে পানি পূর্ণ অবস্থায় পাঁচ ইউনিটের মাধ্যমে ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হয়। এখন পানি না থাকায় ১৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উৎপাদন হচ্ছে।
অন্যদিকে, বর্ষার ভরা বৃষ্টিতে হ্রদের পানি সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছায়। আর গ্রীষ্মে পানি কমতে থাকে। হ্রদ ভরাট হয়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে মৎস্য উৎপাদনে। মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র সূত্র জানায়, ২০১৯-২০ সালে রাঙামাটির মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে হ্রদ থেকে মোট মাছ পাওয়া যায় ৮ হাজার ৫৬৩ মেট্রিক টন। ২০২১-২২ সালে পাওয়া যায় ৬ হাজার ৫২৩ টন।
শুষ্ক মৌসুমে প্রতিবছর সাধারণত তিন মাস বন্ধ রাখা হয় মাছ ধরা। পানি কমে যাওয়ার কারণে গত বছর মাছ ধরা বন্ধ ছিল প্রায় চার মাস। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ্র চন্দ বলেন, হ্রদের প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র (ব্রিডিং গ্রাউন্ড) ভরাট হয়ে গেছে অনেক জায়গায়। এ জন্য মাছ বড় হতে পারছে না।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পানি কমার এমন চিত্র আশঙ্কাজনক। গত এক দশকের মধ্যে হ্রদটির পানি এবারই সবচেয়ে বেশি তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে বলে তাঁদের অভিমত।
এতে নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ, ব্যবসা–বাণিজ্য, মৎস্য উৎপাদন ও পর্যটনে ক্ষতির পাশাপাশি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের উৎপাদন কমেছে। পানি শুকিয়ে যাওয়ায় দূষণের সঙ্গে বেড়েছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পানি পরিশোধন খরচও।
এ প্রসঙ্গে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, নাব্যতা কমে যাওয়ার প্রভাব সবখানে পড়েছে। এতে যাতায়াত সমস্যা যেমন হচ্ছে, তেমনি ভোগ্যপণ্য পরিবহন খরচ বেড়েছে। সেখানে উৎপাদিত ফলমূল জেলা সদরে আনার ব্যয়ও বেড়ে গেছে। হ্রদ থেকে পানি যাচ্ছে না বলেই সমুদ্রের লবণপানি মোহরা পানি শোধনাগার পর্যন্ত চলে আসছে।
প্রায় তিন মাস ধরে আমাদের ৫০টি লঞ্চ বসে আছে। ১০ বছর আগে এ রকম পানি কম থাকা অবস্থায়ও নৌ চলাচল অব্যাহত থাকত। এখন ইঞ্জিনচালিত ছোট ও ডিঙিনৌকাযোগে অনেক বেশি ভাড়া দিয়ে পণ্য আনা–নেওয়া করছে
নৌযান মালিক।

মার্চের মাঝামাঝি সময়ে চর জেগে উঠেছে রাঙামাটির আসামবস্তির সেতু এলাকায়। প্রতিবছর এপ্রিলের দিকে এই এলাকার পানি শুকিয়ে যায়। তবে এবার প্রচণ্ড দাবদাহে এক মাস আগেই পানি শুকিয়ে গেছে। এখন সেতুর নিচের অংশে বিশাল এলাকাজুড়ে চর পড়েছে। গজিয়েছে লম্বা ঘাস। সেখানে বিকেলে ফুটবল খেলায় মেতে ওঠে কিশোর-তরুণেরা।
রাঙামাটির জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি, বরকল, লংগদু, নানিয়ারচর ও বাঘাইছড়িতে এখন নৌ যোগাযোগ বন্ধ। প্রথম তিনটি উপজেলার যোগাযোগ পুরোপুরি নৌপথনির্ভর। অপর তিন উপজেলায় বিকল্প হিসেবে ঘুরপথে সড়ক যোগাযোগ রয়েছে। তাতেও খরচ বেশি পড়ে। ছয় উপজেলার জনসংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ।
পানির স্তর কমে যাওয়ায় বর্তমানে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পাঁচটি টারবাইনের মধ্যে একটি চালু রয়েছে। গত রোববার পানির স্তর ছিল ৭৩ দশমিক ৮২ ফুট এমএসএল। জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক এ টি এম আবদুর জাহের বলেন, কয়েক বছরের মধ্যে এবার পানি বেশি কমেছে। পানির স্তর ৭০–এ চলে এলে চালু থাকা একমাত্র ইউনিটটিও বন্ধ করে দিতে হবে। ওই ইউনিটে এখন ২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে।

রাঙামাটি পৌর এলাকায় দিনে এক কোটি লিটার পানি পরিশোধনের খরচও বেড়ে গেছে বলে জানান রাঙামাটি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী পরাগ বড়ুয়া।
লঞ্চমালিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ৬ ফেব্রুয়ারি বিআইডব্লিউটিএর নৌ চলাচল ট্রাফিক বিভাগ সংস্থার প্রধান প্রকৌশলী (ড্রেজিং) বরাবর জরুরি ভিত্তিতে হ্রদ খননে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চিঠি দেওয়া হয়। এরপর আর কোনো নড়াচড়া নেই।
এর আগে ২০১৬-১৭ সালে কাপ্তাই হ্রদ খননের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে বিআইডব্লিউটিএ। এরপর এ–সংক্রান্ত একটি ডিপিপি তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়। তবে সমীক্ষার ভিত্তিতে ড্রেজিং শুরু হতে সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান।
আরও দেখুনঃ

২ thoughts on “কাপ্তাই হ্রদের পানি কমে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে মৎস্য ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে”